নীলফামারীর জলঢাকায় চাঁদমনি আশ্রম দিয়েছে অনাথ বালিকাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসা। লেখাপড়ার সুযোগ সহ ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা। চাঁদ মনি দিয়েছে জীবনের নিশ্চিত নিরাপত্তা। এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করছেন হাজী পিজিরুল আলম দুলাল।
জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের তিস্তা প্রধান সেচ খালের কোলঘেঁষে চাওড়াডাঙ্গী গ্রামে অনাথ মেয়েদের জন্য ১৯৯৯ সালে ১ একর ১০ শতাংশ জমির ওপর এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা হাজী পিজিরুল আলম দুলাল।১৯৯৬ সালে উত্তরা ব্যাংকের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন তিনি। এরপর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে নিজ গ্রামে চলে আসেন। নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজের অবহেলিত ও অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন ও আশা ছিল তার। এরপর পাঁচ অনাথ শিশুকে নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তিতে ‘চাঁদমনি’ নামে অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন।
কন্যাদের লালন করতে গিয়ে শেষ করেছেন নিজের পেনশনের টাকা। ‘চাঁদমনি’ অনাথ আশ্রমে বর্তমানে বসবাস করছে ৩০ জন অনাথ মেয়ে। তারা বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজে পড়াশোনা করে। পেনশনের টাকায় ২৫ বছর ধরে মেয়ে শিশুদের লালন-পালন করছেন হাজী পিজিরুল আলম দুলাল।
এখানে এতিম, অনাথ ও দরিদ্র মেয়েদের বিনা মূল্যে থাকা খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা রয়েছে।এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষা ও খেলাধুলা সহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় অনেকে অনাথ বালিকা পাচ্ছেন উচ্চ শিক্ষার সুযোগ। গত ২৫ বছরে আট শতাধিক মেয়ে লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করছেন।
যাদের বাবা-মা নেই, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এমন শিশুদের শিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই তার মূল উদ্দেশ্য। এখানে মেয়েদের সপ্তাহে চার দিন কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয় আলেম দিয়ে। তাছাড়া ছবি আঁকার ক্লাস হয় সপ্তাহে এক দিন, মাসে দুই দিন গান শেখানো হয়। এ ছাড়া হস্তশিল্প ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আশ্রমটিতে থাকা নিশাত আক্তার বলেন, এখানে আমি তিন বছর আগে এসেছি। আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন, এজন্য এখানে এসেছি। এখানে খাবার খাচ্ছি, নতুন কাপড় পাচ্ছি কোনো অসুবিধা নেই। বৃষ্টি আক্তার বলেন, এখানে থাকতে অনেক ভালো লাগে। আমি বড় হয়ে চাকরি করতে চাই। এখানে আমি বই পড়ি, ছবি আঁকি, টিভি দেখি, খেলাধুলা করি।
আশ্রমটিতে রান্না ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা মমিনা বেগম বলেন, এখানে প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করছি। রান্নার পাশাপাশি মেয়েদের দেখাশোনা করি। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা হাজী পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, প্রথমে আমি পাঁচজন মেয়ে দিয়ে আশ্রমের কাজ শুরু করি। পরে দেখা যায় আরও অনেকে মেয়ে দিতে চায়। এভাবে ১৫ জন মেয়ে এলো। ১৫ জন মেয়ে দিয়ে এভাবে ৩-৪ বছর চলল। তারপর এক পর্যায়ে ৩৫ জন মেয়ে হলো। আশ্রমের নাম পরে দেওয়া হলো চাঁদমনি। চাঁদমনি মানে চাঁদের মতো শিশু। এটা কোনো রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান নয়। আমরা এ প্রতিষ্ঠানের নামে কোথাও কোনো রেজিস্ট্রেশন করিনি।
আশ্রমটিতে যারা ছিল বা থাকছে তারা দীর্ঘদিন ধরে আছে। কেউ ১০-১২ বছর ধরে, কেউ আবার ৩-৪ বছর ধরে। মেয়েরা বিভিন্ন সময় আসছে, গেছে। এরকম মেয়ের সংখ্যা ১ হাজারেরও বেশি। আর স্থায়ীভাবে যারা বসবাস করছে তাদের সংখ্যাও একশর বেশি। এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে গেছে এদের সংখ্যা দুইশ এর বেশি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে কয়েকজন। আমি অবসরের পর ১৫ লাখের মতো টাকা পেয়েছিলাম, আমার নিজের পৈতৃক কিছু সম্পত্তি ও কেনা কিছু সম্পত্তি ছিল সব এখানে দিয়েছি। এছাড়া কিছু ব্যাক্তি আমাকে সাহায্য করে। আমার ভাগ্নিরা আছে তারাও আমাকে এখানে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে।আশ্রমটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে হলরুম ও লাইব্রেরি। নিজ নিজ কক্ষে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। ক্লাসের বই পড়া ছাড়াও ছবি আঁকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছোটগল্প, উপন্যাস ও গুণীজনদের জীবনী পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
জলঢাকা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী মিন্টু বলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসেও এই অনাথ শিশুদের আলোকিত করে তুলছেন দুলাল। এটি মহৎ উদ্যোগ। তার এই কাজে সবাইকে সহায়তার হাত বাড়ানো উচিত।